লেখা:দেবপ্রিয় প্রামানিক:
মফস্বল শহরের অঙ্কের শিক্ষক বিমল বাবু, বিমল চন্দ্র পাঠক। শহরের খুব সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব এই প্রৌঢ় মানুষটি। খুব অল্প বয়স থেকে প্রথমে বাড়িতে পরে স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এখন স্কুলের চাকরি জীবন প্রায় অন্তিমপর্যায়ে উপনিত।
বাড়িতে শিক্ষকতাটা ছাড়তে পারেননি, শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই সব ছাত্রছাত্রী চলে আসে বাড়িতে পড়বে বলে। এখনের বেশীরভাগই ওনার প্রাক্তন ছাত্র বা ছাত্রীর সন্তান। এঁদের বিমল বাবুও না করতে পারেন না। দু-চারটে তো এমনও আছে মাইনেও দেয় না বিভিন্ন অজুহাতে।
বিমল বাবুও টাকার জন্য ওদের কিছু বলেন না। কখনো কোন ছাত্র নালিশ করে -“স্যার, অমুক ছেলেটা আপনাকে ফিস্ দিচ্ছে না তিনমাস থেকে, সেদিন আড্ডাতে বলেছে।”
বিমল বাবু একগাল হেসে বলেন,
-“না রে, ও ভালো ছেলে, আমাকে গাড়ি কিনে দেবে বলে টাকা জমাচ্ছে!”
বিমল বাবু অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যতটা ক্ষুরধার মস্তিষ্কের অধিকারী মানুষ হিসেবে ততটাই নরম ও ভালো মনের।
ছাত্রদের বকাঝকা, মারা এসব তাঁর পক্ষে করা অসম্ভব। বাবা-বাছা করে ছাত্রছাত্রীদের অঙ্ক করিয়ে চলেছেন আজীবন।
শতদল বিমল বাবুর বহু পুরোনো এক ছাত্র, পড়াশোনায় খুব ভালো না হলেও ব্যবহার অত্যন্ত ভালো। বর্তমানে শহরের নাম করা ব্যবসায়ী। নিজের একমাত্র ছেলে শতরূপ কে বিমল বাবুর কাছে অঙ্ক শেখাতে ভর্তি করেছেন।
শতরূপ সপ্তাহে তিন দিন সকালে বিমল বাবুর কাছে আসে। ও এখন ক্লাস নাইন। সোম, বুধ, শুক্র শতরূপের পড়া থাকে বিমল বাবুর কাছে।
শতদল বাবু বেশ নিশ্চিন্তে আছেন শতরূপের ভবিষ্যতের ব্যপারে।
এরকমই এক নভেম্বর মাস, সাল টা ১৯৯৩, বুধবার, শতদলবাবু সকালে একটু কাজে বিমল বাবুর বাড়ির কাছে গিয়েছিলেন। ওনার মনে হলো আজ তো এই সময় শতরূপ বিমল স্যারের কাছে পড়তে এসেছে, যাই একবার গিয়ে দেখে আসি ছেলে কেমন পড়াশোনা করছে, আর স্যারকেও তো বিজয়ার প্রনামটা করা হয়নি।
বাইকটা বিমল বাবুর বাড়ির বাইরে রেখে, গেট খুলে ভিতরে ঢুকে স্যারের ঘরের দরজাতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন
-“স্যার চিনতে পারছেন, আমি শতদল,আপনার ছাত্র আর ঐ যে এখন পড়তে আসে শতরূপের বাবা…. আসলে স্যার ঐ ছেলে কেমন পড়াশোনা করছে দেখতে এলাম।”
বিমল বাবু অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন
-“আরে আয় আয়, খুব ভালো করেছিস এসে, নাহলে এবার আমাকেই তোর কাছে একবার যেতে হতো।”
শতদল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো
-“কেন? স্যার কেন? আর শতরূপকেও তো দেখছি না! ও কি পড়তে আসেইনি?”
বিমল বাবু বললেন
-“না না, তোর ছেলে পড়তে ঠিকই আসে কিন্তু এসেই ব্যাগটা আমার সামনে রেখে এর বাড়ির পেয়ারা, ওর বাড়ির জাম, আমার বাড়ির আম, এই সব পেরে সব বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে বসে বসে খায়, তুই আয় আমার পাশটাতে বস, জানালা দিয়ে দেখ তোর ছেলে আমার বাড়ির পিছনের কামরাঙা গাছে উঠে কি সুন্দর কামরাঙা পারছে”।
শতদল বাবুর কান লাল হয়ে গেছে, ছেলের উদ্দেশ্যে ভাবছেন একবার তুই বাড়িতে চল….
তবে বাড়িতে গিয়ে উত্তম মধ্যম খেয়েও শতরূপের বিমল স্যারের প্রতি ভক্তি কয়েকগুন বেড়ে গেল।
কারণ শেষ তিনমাস ও যে স্যারকে মাইনে দেয়নি, এই কথাটা স্যার ওর বাবার কানে তোলেননি।
আর এক মাসের মাইনে বাবার থেকে নিতে পারলেই একটা নতুন ব্যাট, পুরোপুরি শীত পরার আগেই কিনে ফেলবে শতরূপ।