
লেখক দেবশ্রী নন্দী :
ছোট্ট একটা নাম “চুপি”। সত্যি বলতে কি একদম জানা ছিলোনা জায়গাটার সম্বন্ধে। গত বছরই ঈদের দিন খুব ভোরে পাড়ি দিয়েছিলাম, জানতে কি আছে ওখানে। এক দেখায় ভালো লেগেছিল। কোনো বিখ্যাত পাহাড় কিম্বা গভীর অরন্য নয় সে। নয় কোনো বরফাবৃত তুষার হিমালয়ের কোনো শৃঙ্গ। সে নেহাতই একটি ছোটো জলাশয় বা ভালো ভাবে বললে লেক বলতে পারেন। অক্সবো লেক নামেই পরিচিত। স্থানীয়রা বলেন “চুপীর চর”।
একদম ঘরের কাছেই আরশিনগর। প্রচুর পরিযায়ী পাখির আনাগোনা, তাদের কলকাকলি দেখতে দেখতে একটা দিন দিব্বি কেটে যায়। আমাদের ভালো লেগেছিল ওখানকার সবুজ প্রকৃতি, চারিদিকে ছড়ানো পাখীদের সাম্রাজ্য আর তার পাশেই খুব সুন্দর করে সাজানো একটি গেস্ট হাউস। ঈদের দিন সেরম কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই চলে গেছিলাম, তাই আর রাত্রিবাস হয়নি। কিন্তু মাঝি ভাই খুব যত্ন নিয়ে পাখি দেখিয়ে ছিলেন।
তাই এবার শীতের এক রবিবার এক্কেবারে তৈরী হয়ে গিয়েছিলাম। দুমাস আগে গেস্ট হাউস বূকিংগ করে একটা রাত কাটিয়ে ছিলাম চুপিসারে। চুপি কাষ্ঠশালী পাখিরালয়ে!
চুপি ফটোগ্রাফারদের খুব পছন্দের জায়গা। আসেপাশের স্থানীয় মানুষ জন আসেন এখানে পিকনিক করতে। কিন্তু কোনো ডিজে বা সাউন্ড সিস্টেম বাজানো যাবে না। তাতে পাখীদের অসুবিধা হবে। এমন একটা জায়গায় আমরা 15/12/2018 সকালে রওনা হলাম 6জন মিলে। গেস্ট হাউসে দুপুরের লাঞ্চ , বিকেলের চা ও স্নাক্স ও রাতের খাবার থাকবে এটা জানতাম। আমাদের চেক ইন টাইম ছিলো 11টায়। আমরা সেইমত রাস্তায় ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। আমরা যখন পৌঁছাই ওখানে তখন প্রচুর গ্রূপ পিকনিক করতে এসেছে। তবে গাড়ি পার্ক করার সুবন্দোবস্ত আছে ।
আমরা প্রায় 11 টা নাগাদ কটেজে চেক ইন করতেই মনটা ভরে গেলো। একদম পরিপাটি করে সাজানো কটেজের ভিতরটা। মোট 4টে কটেজ আছে। এক একটি তে 4জন মতো থাকা যায়। একটু অ্যাডজাস্ট করতে হয় আর কি। কটেজ গুলি ওয়েল ফার্নিশ্ড! সব আছে। ওনারা গেস্ট কে নতুন গামছা দেন ব্যবহার করার জন্য। ও হাঁ বলতে ভুলে গেছি ইলেক্ট্রিক কেট্ল ও সাথে টিব্যগ ও থাকে। ইচ্ছে মতো চা বানিয়ে খাবার জন্য।
কটেজের সামনে সুদৃশ্য লন যা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আমরা এসেই আগে সকলের সাথে পরিচয় করলাম। দুজন দিদি কিচেন এ রান্না করছিলেন, সে দিনের মেনু ছিলো সব সবজি দিয়ে আর পোস্ত দিয়ে একটা নিরামিষ তরকারি, ডাল, রুই মাছের ঝোল, চাটনি , পাঁপড় আর মিষ্টি। আর সঙ্গে অবশ্যই ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত। স্নান করে ফ্রেশ হয়ে আমরা খেয়ে নিলাম। একটু পরেই মাঝি ভাই এলেন , দুটো নৌকো ভাড়া করা হয়েছিল। ছোট্ট ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকো , মাঝে বাঁশের ফালি দিয়ে বসার খাসা বন্দোবস্ত।
ডিঙ্গি নৌকোগুলোতে একসঙ্গে চারজনের বসার ব্যবস্থা করা আছে। আগে পিছে করে বসতে হয়। আমরা যেহেতু ছয়জন তাই দুটো নৌকোয় তিনজন তিনজন করে ভাগ হয়ে গেলাম। মাঝিভাই নৌকো টেনে চললো। কিন্তু কোথায়….?
পুরো লেক কচুরিপানার জঙ্গলে ভর্তি। কাঁচের মতো স্বচ্ছ জলের নিচে তাকালে শিকড়ের জাল বিছানো, তার মধ্যেই মাছ খেলা করছে। সারাটা লেক জুড়ে তখন বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির মেলা বসেছে। নৌকো একটু এগোলেই পাখা ঝাপটিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গিয়ে একটু দূরেই আবার জলের ওপর বসে পড়ছে। দেখেই যেকোন মানুষের মন ভালো হতে বাধ্য।
যেহেতু আমরা আরও একটা দিন থাকবো তাই প্রথম দিন গেলাম রেড ক্রেষ্টেড পোচার্ড দেখতে। প্রায় শদেড়েক পোচার্ড আছে । মাঝিরা এমন দক্ষ যে তারাই চিনিয়ে দিলেন কোনটা পুরুষ আর কোনটা মেয়ে পাখি। দারুন গাইড। লেকের ভিতর কচুরিপানার জঙ্গল তার ভিতর দিয়ে দাঁড় বেয়ে বেয়ে রাস্তা করে নিয়ে চলেছেন, আমিও কিছুক্ষন দাঁড় বাইবার চেষ্টা করলাম। এদিকে আমার বর আর ছেলে তো ক্যামেরা নিয়ে অনর্গল শার্টার প্রেস করেই চলেছে।
আমরা সন্ধ্যে অবধি নৌকো বিহার করলাম। বিস্তৃর্ণ জলাভূমি চারিদিকে শুধুই পাখির কলতান অদ্ভুত এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।
আমরা সন্ধায় ফিরে দেখি কিছু লোক পাড়ে সার দিয়ে বসে। ওনারা কোথাও কি যাবে? জিজ্ঞাসা করতে মাঝিভাই যা বললেন তাতে আমরা বিস্মিত বোধ করলাম। ওনারা টোটাল 18 জন মাঝি আছেন যারা রেজিস্টার্ড এবং রোজ সন্ধ্যা বেলায় সব মাঝিরা একসাথে মিলে নিজেদের ইনকাম সমান ভাবে ভাগ করে নেন, যাতে সবার ইনকাম সমান হয়। এমন অনেকে আছেন যাঁরা তেমন ভাবে ইনকাম করতে পারেন না, তাঁদের যাতে ঠিকমতো সংসার চলে তাই এই ব্যবস্থা। সত্যিই বলছি শুনে আমরা অভিভূত হয়েছিলাম।
আমাদের বুকিং ডিটেলসে বার্বিকিউর উল্ল্যেখ ছিল কিন্ত গিয়ে জানা গেলো যে, বার্বিকিউ করার লোক নেই তখন আমরাই সে দায়িত্ব নিয়ে নিলাম। ওখানকার কেয়ারটেকার দিলীপ দা কে দুপুরেই টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম চিকেন বার্বিকিউ র জন্য ব্যবস্থা করতে। শীতের রাতে প্রায়ই বাড়িতেই বার্বিকিউ করি। তাই অসুবিধা হবার কথাও নয়। আগেই বলে দিয়েছিলাম চিকেন কি ভাবে কাটিয়ে আনবে? সাইজ কতটা বড় হবে ইত্যাদি। আর চিকেন এনেই যেন ভালো করে ধুয়ে সব মসলা মেখে রাখে। সন্ধ্যায় ফিরে এসে লেগে গেলাম বার্বিকিউ করবার জন্য। দিলীপ দা সব ব্যবস্থা করে কিন্তু আমি যেটা বলিনি সেটা হলো কি কি মশলা দিয়ে হবে। আমার ধারণা ছিলো রান্নাঘরের দিদিরা সবই জানেন। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা এসে দেখলাম চিকেন মাখা আছে অবশ্যই কিন্তু একদম চিকেনের ঝোলের জন্য জীরা আদা রসুন দিয়ে মাখা। আমরা তাই বার্বিকিউ করে খেয়েছিলাম। লনের আধো আলো আধো অন্ধকারে গরম গরম বার্বিকিউ চিকেন আর কয়েক রাউন্ড চা সন্ধ্যেটা দারুন জমে গেছিলো।
পরদিন খুব ভোরে মানে প্রায় 5টা নাগাদ আমরা আবার নৌকা চেপে রওনা হলাম। এবার পাড়ি দেবো মূল গঙ্গার দিকে। যেখানে আমাদের জন্য কি আছে দেখি?
ওই অন্ধকারে বইঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আমাদের খুব ভালো লাগছিল। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে আমরা যে রাস্তা দিয়ে গেলাম তা সত্যিই দারুন। গায়ের উপর পাকা কাশফুলের আলতো ছোঁয়া আর সরু খাঁড়ি বেয়ে চলা, মনে হচ্ছিলো যেন আমাজন অভিযান এ যাচ্ছি। সে যাই হোক আমরা গিয়ে পড়লাম মূল গঙ্গায়। দূরে মায়াপুরের চন্দ্রোদয় মন্দির দেখা যাচ্ছে। হটাৎ কী একটা নৌকার পাসে ডাইভ দিল। আমি শুধু পিঠ টা দেখতে পেয়েছিলাম। মাঝি ভাই বললো ওটা “শুশুক”। এরপর আমরা অস্প্রে র দেখা পেলাম। বাংলায় একে বলে বিশালাকার বাজপাখি। গঙ্গার ভিতর থেকে মাছ ধরে খায়। একে দেখতেই এতদূর আসা। এরপর আরো অনেক পাখি দেখলাম। আজ আমাদের ফিরবার পালা। সেই ভোর থেকে পাঁচ ঘণ্টা নৌকোতে বসে কোমরের অবস্থা টাইট। এরপর রিসোর্টে ফিরে সব গুছিয়ে নিয়ে স্নান সেরে একেবারে চেক আউট করে প্রাতঃরাশ করলাম ..লুচি, সাদা আলুর চচ্চরি আর মিস্টি দিয়ে।
দুটো দিনের এক অসাধারণ পাখি ভ্রমণ আর একটু পরেই শেষের পংক্তিতে এসে পৌঁছবে। আমরা ট্রেনে আসিনি। নিজেদের গাড়িতে এসেছিলাম গুগল ম্যাপ দেখে। এবার ফেরার পালা। খুন মন খারাপ লাগলো। ওই রান্না ঘরের দিদিদের জন্য, দিলীপ দার আন্তরিক ব্যবহারের জন্য, ওই মাঝি ভাইদের জন্য ও আর সর্বোপরি পরিযায়ী দের জন্য। চুপি চুপি ওদের বললাম আগামী শীতে আবার আসবো কেমন! তোরা আবার আসবি তো আমাদের সঙ্গে ভাব করতে কয়েকশো মাইল পাড়ি দিয়ে!
ওরা বললো আসবো …আসবো…আসবো!
শীত তো আর কদিন পরেই আসি আসি করছে আমাদের দক্ষিনবঙ্গে। বাড়ির ছোটদের অনেকেরই বার্ষিক পরীক্ষা প্রায় শেষের পথে। আবার অনেকের শীতের ছুটি শুরু হবে। এই তো সময় একটা দিন পাখিদের রাজত্বে ঘুরে আসার।
বেরিয়ে পরুন টুপি, সানগ্লাস, জল, শুকনো খাবার আর অবশ্যই ক্যামেরা নিয়ে (ওটি ভুললে চলবেনা কিন্তু)।
*এখানে পৌঁছানো খুবই সহজ …..হাওড়া বা শিয়ালদা থেকে কাটোয়া লোকাল ধরে পুর্বস্থলি স্টেশান এ নেমে টোটো বা অটো ধরে পৌঁছে যান ‘ চুপি’।
*গাড়িতে আসতে চাইলে গুগল ম্যাপ আপনাকে পথ দেখাবে ।
*কটেজ বূকিংগ করতে চাইলে purbostholi.com সার্চ করুন, সব কিছু পাবেন । অনলাইন বুকিং হবে।
*নৌকা ভাড়া ঘন্টা প্রতি 150/-
ছবি তোলার পুরো কৃতিত্ব আমার স্বামী ও ছেলের (অনির্বান ও অর্কপল )!